আমি পেশায় একজন পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর দুই লক্ষ সদস্যের মধ্যে একজন হতে
পেরে নিজেকে গর্বিত মনেকরি। কে কি বল্ল সেটার তৌয়াক্ষা না করে নিজের পেশাকে
শ্রদ্ধার সাথে সবার উপরে রাখি। পেশা হিসেবে সরকারী চাকরি করে মানুষের পাশে
দাড়ানোর ও সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, এর চাইতে চরম আনন্দের আর কি হতে পারে।
আপনারা হয়ত বলবেন এই টপিকটি আমার ব্লগের বিষয়ের সাথে যায় না। হা, আমি স্বীকার
করছি যায় না। তারপরও চরম বাস্তবতার সম্মুখিন হয়ে নিজের অনুভূতিগুলো সকলের সামনে
তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
দিনের আলো পেরিয়ে রাতের অন্ধকার যাপনের পর ২৪ ঘন্টায় মিলে এক দিন হিসেব করা হয়।
তবে পুলিশ সদস্যদের জন্য ৩২ ঘন্টায় এক দিন করে দিতে পারলে ভালো হত। পুলিশ
বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৮ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়।
তারপর বাকী ৬ ঘন্টা ভাগ করে তার পরিবার, সন্তান-সন্ততি, বাবা-মা,
আত্নীয়-স্বজনদের দেওয়ার পর যদি কিছু সময় বাকী থাকে তবে তা নিজের গোসল,
খাওয়া-দাওয়া সহ অন্যান্য কাজে ব্যয় করতে হয়। এত অল্প সময়ে সবকিছু করার পর একজন
পুলিশ সদস্যের নিকট বিনোদন নামক ব্যবস্থাটি সময়ের তুলনায় অতি বিলাসী বস্তু বলে
মনে হতেই পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি পুলিশ সদস্যের কাছে বিনোদনের কোন সময় নেই।
কারণ তারা মানুষ নয়, তারা হচ্ছে পুলিশ!!
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর প্রায় দুই লক্ষ পুলিশ সদস্যের মধ্যে কর্মস্থলে পরিবার
নিয়ে বসবাস করার মত আবাসন এর ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ পুলিশ সদস্যদেরকে তাদের
পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। যার ফলে বাবা মায়ের আদর-স্নেহ, স্ত্রীর
ভালোবাসা, ভাই বোনের ভাতৃত্বের বন্ধন, ছেলে মেয়ে কোলে বসিয়ে আদর করা কিংবা
হাতেখড়ি শুরু করানোর মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলি থেকে সদা সর্বদা বঞ্চিত হতে হয়।
এগুলো আমাদের (পুলিশের) প্রয়োজন হয় না। কারণ তারা মানুষ নয়, পুলিশ।
আপনি হয়ত মানবাধিকার লঙ্গন বা মানবাধিকারের দাবি নিয়ে অনেক আন্দোলন করেছেন
কিন্তু কখনো কি মানবাধিকার লঙ্গনের শিকার হয়েছেন বা মানাবাধিকার লঙ্গন হওয়ার
চরম চিত্র নিজ চোখে দেখেছেন কিংবা উপলব্দি করেছেন? হয়তবা আপনি সেটা পরখ করার মত
বাস্তবতার সম্মুখিন হননি। কিন্তু আমি পুলিশ সেই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখিন হয়েছি
এবং অন্যদের লঙ্গনের শিকার হতে নিজ চোখে দেখেছি। এটা হতেই পারে, মানুষের
ক্ষেত্রে না হলেও পুলিশের ক্ষেত্রে হওয়াটা খুব বড় কিছু নয়। কারণ এরা পুলিশ,
মানুষ নয়।
ডিএমপি, ঢাকায় চাকরি করার সুযোগ আমার হয়ে উঠেনি কিন্তু কাজের প্রয়োজনে টানা এক
মাস সহ বিভিন্ন সময়ে ডিএমপি, ঢাকা’র ব্যারাকে থাকতে হয়েছে। সেখানে একজন দেশ
রক্ষকের মানবাধিকার কিভাবে লঙ্গন হচ্ছে তার চিত্র নিজে পরখ করে দেখার সৌভাগ্য
হয়েছে। ঢাকাস্থ রাজারবাগে ডিএমপি পুলিশের জন্য অনেকগুলো ব্যারাক রয়েছে। বহিঃ
দৃষ্টিতে দেখলে মনেহবে উচু উচু দালানের মধ্যে পুলিশ বেশ আরামেই আছে, কিন্তু
ব্যারাকের ভীতরে অবস্থান করলে আপনার ধারনাকে ধাক্কা লাগিয়ে দেবে।
ব্যারাকের একটি রুমে যেখানে ৩০ জন লোক থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে সেখানে প্রায়
৭০-৮০ জন পুলিশ সদস্য বসবাস করছে। এক দল পুলিশ দিনের বেলায় ডিউটি করছে আরেক দল
ঘুমাচ্ছে। ঠিক একই ভাবে আরেক দল রাতের বেলায় ডিউটি করছে তখন দিনের পার্টি একই
ব্যারাকের একই খাঁটে ঘুমাচ্ছে। এখানে মানবাধিকার দেখার মত কেউ নেই। কারণ ওরা
মানুষ নয়। মানুষ হলেত মানবাধিকার থাকত। ওরাত পুলিশ!!
ঘোষ খাওয়া নিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের যত বদনাম। খাঁটি বাংলা ভাষা থেকে শুরু
করে অনেক উন্নতমানের ভাষা (মাদার......... বাইন) ব্যবহার করে গালি দিতেও কারো
মুখে বাধে না। সকলের দৃষ্টিতে বাংলাদেশর পুলিশ ব্যতীত দেশের অন্যান্য সকল
ডিপার্টমেন্ট দুধ আর তুলসি পাতার সমন্বয়ে দৌত করে পাক পবিত্র করা। কেউ কি
চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারবে যে, অমুক ডিপার্টমেন্ট সুদ, ঘুষ ও দূর্নিতী ছাড়া
ভালভাবে চলছে? অন্য সংস্থাগুলোর আকাম কুকাম আড়ালে রেখে রাস্তায় ট্রাফিক
হাবিলদার ২০ টাকা নিচ্ছে সেটা নিয়ে সবাই আলোচনায় মাঠে নেমে পড়ে। কারণ ওরা
........ পুলিশ!!
আপনি কি কখনো গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ রুদের মধ্যে রাস্তা দিয়ে টানা এক ঘন্টা
হেঠেছেন। আমার মনেহয় কখনো এমনটি হয়নি। কিন্তু আমার ট্রাফিক পুলিশ গ্রীষ্মের সেই
কড়া রুদে এক জায়গায় দাড়িয়ে টানা ৮ ঘন্টা ডিউটি করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
আপনি তখন আপনার স্বাদের BMW গাড়ীতে বসে সেই ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় রাস্তার
জ্যাম পার হয়েছেন। আপনি কি কখনো সেই ট্রাফিক হাবিলদার এর দিকে সদয় দৃষ্টিতে
থাকিয়ে ছিলেন বা গরমের মধ্যে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক পুলিশকে আপনার গাড়ীর সীট
বেল্টের পাশে থাকা এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। না, কখনো
করেননি। কারণ ওরা মানুষ নয়, পুলিশ!!
মুসলমানদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ বছরে মাত্র দু বার আসে। আপনি
ক’বার পরিবার ব্যতীরেকে একা একা ঈদ উদযাপন করেছেন। আমার মনেহয় পুলিশ ছাড়া অন্য
কারো ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। কিন্তু আমি পুলিশ নিজের পরিবার ছাড়া, মা-বাবা ছাড়া
বহুবার একা একা ঈদ উদযাপন করেছি।
এমনকি আপনারা যখন ঈদগাহ্ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ছেন তখন আমি ঈদগাহ্ এর মাঠে আপনার
নিরাপত্তা দিয়েছি। আমার চাকরি যখন এক বছর তখন আমি মৌলভীবাজার জেলার সদর থানায়
কর্মরত ছিলাম। সে বার ঈদের সময় ছুটি পাইনি।
বরংচ ঈদের দিনে ঈদ উৎসব উদযাপনের পরিবর্তে সদর থানাধীন ঈদগাহ্ মাঠে ঈদের নামাজ
পড়ার জন্য আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তা ডিউটি করেছি। সে দিনের অনুভুতির কথা ভাষায়
প্রকাশ করে কাউকে বুঝানো সম্ভব হবে না। ঐ দিন আমার সাথে আমার এক কলিগ ছিল। তার
বাড়ী নারায়নগঞ্জ জেলায়। সেও আমার মত ছুটি যেতে পারেনি এবং ঐ দিন এক সাথে ঈদগাহ্
মাঠে ডিউটিতে ছিলাম।
আগত মুসল্লিরা যখন নামাজ পড়ছিল তখন সে উচ্চ সূরে কান্না শুরু করে। তার সে দিনের
কান্না আজও আমাকে বিচলিত করে। এ রকম হাজার হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে যারা বিশেষ
মুহুর্ত ও প্রয়োজনের সময় সরকারী দায়িত্ব পালনের জন্য ছুটির অভাবে তাদের
পরিবারকে সময় দিতে পারে না। এমনো অনেক ঘটনা আছে যে, পুলিশ সদস্য দীর্ঘ দিন যাবৎ
ছুটি না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। এই হচ্ছে
মানুষের জীবন... দুঃখিত, পুলিশের জীবন।
স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে দুটি পক্ষের
(বাদী-বিবাদীর) সাথে কাজ করতে হয়। বহিঃ দৃষ্টি থেকে ব্যাপারটা যতটা সহজ মনেহয়
আসলে দুটি পক্ষের সাথে সমন্বয় করে কাজ করাটা কতটা কঠিন তা একজন পুলিশের চেয়ে
ভালো করে কেউ বলতে পারবে না।
পুলিশের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যে একটি হচ্ছে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া।
তদন্ত পরবর্তী সময়ে পুলিশকে বাদী-বিবাদী দুটি পক্ষের মধ্যে যে কোন একটি পক্ষের
জন্য কাজ করতে হয়। সুতরাং পরিস্থিতির বিবেচনায় আপনি আজ যে পুলিশকে বন্ধু হিসেবে
গ্রহন করছেন সে হয়ত কাল ভিন্ন কোন পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজেকে পুলিশের শত্রু
ভাবা শুরু করবে।
অতএব, এহেন উভয় সঙ্কটের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করাটা যে কতটা কঠিন কাজ তা
একজন পুলিশ সদস্য ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে আনুধাবন করাটা মনে হয় একটু কষ্টকর
বলেই বিবেচ্য হবে। এভাবে উভয় সঙ্কটের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে জীবনের
ঝুকি এমনি এমনি চলে আসে।
উপরের ছবিতে যাকে দেখতে পাচ্ছেন সে হচ্ছে একজন তরুন উদীয়মান মেধাবী ও সৎ পুলিশ
সদস্য। মাত্র দেড় বছর চাকরি করতে সমর্থ হয়েছে। মূলত এই তরুন ছেলেটিকে কেন্দ্র
করে আমার আজকের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা। এই ছেলেটি আমার ইউনিটের একজন পুলিশ
সদস্য। কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রয়োজনে দু-এক বার তার সাথে কথা হয়েছে।
দেশ রক্ষায় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে গতকাল থেকে সে একজন প্রয়াত পুলিশ সদস্য।
আমাদের ইউনিট হতে সুনামগঞ্জ জেলাধীন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানা এলাকায় ওয়ারেন্ট
তামিল করতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হলে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রাথমিক
চিকিৎসার পর সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য
নিয়ে আসার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
গতকাল রাত ১১.০০ ঘটিকার সময় তার লাশ সিলেট হাসপাতালে দেখতে গিয়ে নিজেকে সংযত
রাখতে পারিনি। অত্র ইউনিটের প্রায় ২০০-৩০০ জন পুলিশ সদস্য তাকে হাসপাতালে দেখতে
গিয়ে সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এত অল্প বয়সে মায়ের কোল খালি করে যাওয়াটা কেউ
সহজভাবে নিতে পারছিল না। আজ দুপুর ০২.০০ ঘটিকায় সিলেট পুলিশ লাইন্স মাঠে
জানাযার নামাজের পর তার লাশ বাড়ীতে হস্তান্তর করা হয়।
জানি না লাশ পাওয়ার পর তার আত্মীয় স্বজনদের কি অবস্থা হবে? সরকারী দায়িত্ব পালন
করতে গিয়ে এভাবে মাসের পর মাস কত পুলিশ সদস্য মায়ের কোল খালি করে, স্ত্রীকে
বিধবা আর সন্তানকে এতিম করে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে।
এই পার থেকে ঐ পারের অনুভূতি বুঝা সবার দ্ধারা হয় না।
ReplyDeleteআসলে পৃথিবীটা আজব, সেই সাথে মানুষও ভিন্ন ভিন্ন।
Deleteধন্যবাদ।
ReplyDeleteVai ami all time police er sathe thaki jani koto kosto kore police amader deshe akhono onk vlo police ase jara nijer jibon diye manuser seba kore
ReplyDeleteধন্যবাদ...
DeleteTnq apnake,ai golpota pore coke pani cole ascilo sotty police sarata din sodo manoser jonno diye jai sadaron manos jodi seta bojte parto kokono negatively cinta kortona ,,, amio onk somoi amn o dekeci police ke, bipod grosto manoser pase darate.
ReplyDeleteধন্যবাদ...
Delete